সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন আইডি ও পেজ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহর একটি ছবি এবং কয়েকটি স্ক্রিনশট পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, এই স্ক্রিনশটগুলো বান্নাহ এর সাথে এক তরুণীর একান্ত আলাপের। যেখানে বান্নাহ ওই নারীকে অবমাননাকর ও হয়রানিমূলক কথা বলেছেন। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ১ সেপ্টেম্বর ‘Kobir Khan’ নামক একটি আইডি থেকে স্ক্রিনশটগুলো পোস্ট করে উল্লেখ করা হয়, “মাবরুর রশিদ বান্নাহ এই নারীর সাথে যা করেছে, দেশে স্বাভাবিক আইন ও বিচার থাকলে এই কাজ "Aggregated harassment over text" হিসেবে গন্য হইতো এবং নারীকে যৌন হয়রানি করার জন্য জেলে থাকতো। এইসব বাটপার গত ১৬+ বছর মুখে কুলুপ ঢুকায় বইসা ছিলো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি হয়ে উঠার চেষ্টা করছে। আর বিএনপি মধ্যে কিছু মানুষ এদেরকে স্পেস দিচ্ছে। বিএনপির লোকজনের জাজমেন্ট দেখে আমি বিরক্ত। আপডেট: বেশকিছু লকড এ্যান্ড ফেইক এ্যাকাউন্ট এসে কমেন্ট করছে। যথারীতি জায়গা মত মেরেছি। ভালোই লেগেছে। দ্রুত ফলাফল পাচ্ছি। বিএনপিকে ডানে ঠেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের রিসোর্স ডেপ্লয় করা হচ্ছে এবং হবে। আমরা প্রতিটা রিসোর্স ধরায় দিবো। এইটা ২০০১-০৬ না, ইনফিলট্রেট করা এত সহজ হবে না।” নিচে পোস্টটির স্ক্রিনশট দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, দাবিটি সঠিক নয়। ফেসবুকে প্রচারিত আলোচ্য পোস্টের স্ক্রিনশটগুলো এডিটেড বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আলোচ্য পোস্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে মোট ৯টি হোয়াটসঅ্যাপ এর স্ক্রিনশট যুক্ত করা হয়েছে। এসব স্ক্রিনশটগুলোর ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের ইন্টারফেসের নম্বর বার বা প্রোফাইল বার-এ ফোন নম্বর এবং প্রোফাইল ছবির মধ্যে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। স্ক্রিনশটগুলোতে মোটাদাগে পাঁচ ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে, যার মধ্যদিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় স্ক্রিনশটগুলো এডিটেড। নিচে অসঙ্গতিগুলো ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। শুরুতে ৯টি ছবির কোলাজ দেখুন--
এক.
সাধারণত হোয়াটসঅ্যাপের ইন্টারফেসের নম্বর বার বা প্রোফাইল বার-এ ১১ ডিজিটের নম্বরের শেষ ছয় ডিজিটের মধ্যে কোনো স্পেস বা ফাঁকা থাকেনা। কিন্তু আলোচ্য স্ক্রিনশটগুলোতে স্পেস দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকের প্রচারিত পোস্টটির ৯ নাম্বার স্ক্রিনশট (বামে) এবং আসল হোয়াটসঅ্যাপের (ডানে, যেটা বুম বাংলাদেশ নমুনা হিসেবে নিয়েছে) ইন্টারফেসের পার্থক্য দেখুন--
দুই.
নম্বর বার-এ প্রফাইল ছবি সর্বদা আনুভূমিকভাবে বাম পাশে এবং উলম্বভাবে একদম মাঝে থাকে। কিন্তু স্ক্রিনশটগুলোর একটির নম্বর বার বা প্রোফাইল বার অন্যটির থেকে আলাদা দেখা যাচ্ছে। কোথাও প্রোফাইল ছবি উলম্বভাবে সঠিক জায়গায় নেই। কোথাও প্রোফাইল ছবি আনুভূমিকভাবে সঠিক জায়গায় নেই। ফেসবুকের প্রচারিত পোস্টটির অষ্টম স্ক্রিনশট বামে এবং ডানে রেখে, মাঝে হোয়াটসঅ্যাপের প্রকৃত একটি স্ক্রিনশট রেখে ইন্টারফেসের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হলো। যাতে দেখা যাচ্ছে, অষ্টম স্ক্রিনশটের লে-আউটের মধ্যেই ছবি বারের উপরে উঠে গেছে। দেখুন--
তিন.
নম্বরটি বারের উপর-নিচে (উলম্বভাবে) এবং ডানে-বামে জায়গার (আনুভূমিকভাবে) ঠিক মাঝখানে থাকে। কিন্তু স্ক্রিনশটগুলোতে এর ভিন্নতা দেখা গেছে। নম্বর বারের এই অসঙ্গগতির ফলে ৯টি স্ক্রিনশটে নয়টি আলাদা আলাদা ধরণের অমিল পাওয়া গেছে। ফেসবুক পোস্টটির প্রথম স্ক্রিনশট (বামে) ও দ্বিতীয় স্ক্রিনশটের (ডানে) মধ্যে অমিল দেখুন--
চার.
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নম্বরটি বারের উপর-নিচে (উলম্বভাবে) এবং ডানে-বামে জায়গার (আনুভূমিকভাবে) ঠিক মাঝখানে থাকে। তবে পোস্টে স্ক্রিনশটগুলোর কোনো কোনো স্ক্রিনশটে নাম্বারটি উলম্বভাবে সঠিক জায়গায় নেই, কোথা আনুভূমিকভাবে সঠিক জায়গায় নেই। আনুভূমিকভাবে সঠিক জায়গায় না থাকার ফলে নম্বরটি ডানপাশের ভিডিও কল আইকনের সাথে প্রায় মিশে গেছে যা স্বাভাবিক নয়। এমনকি নম্বর ডানে সরে যাওয়ায় প্রোফাইল ছবি ও নম্বরের যে স্বাভাবিক দূরত্ব সেটিও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ফেসবুকের প্রচারিত পোস্টটির প্রথম ও দ্বিতীয় স্ক্রিনশটের প্রোফাইল ছবির অবস্থান ও নম্বরের অবস্থানের অমিল দেখুন (বামে) এবং প্রকৃত হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনশটের (ডানে) ইন্টারফেসের সাথে এর পার্থক্য দেখুন--
এখানে প্রথম স্ক্রিনশটে নম্বর ও প্রোফাইল ছবির দূরত্ব বেশি এবং এখানে নম্বরটি উলম্ব এবং আনুভূমিকভাবে মাঝখানে নেই। তাই নম্বরের সাথে ভিডিও কল বাটনের সাথে দূরত্ব নেই। উলম্বভাবে ঠিক মাঝখানে আছে কিনা এটা ভিডিও কল বাটনের সাথে নম্বরের অবস্থান তুলনা করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
পাশাপাশি পোস্টটির দ্বিতীয় স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে উলম্বভাবে মাঝে থাকলেও আনুভূমিকভাবে মাঝখানে নেই তাই প্রোফাইল ছবির সাথে আগের স্ক্রিনশটের মতো এত দূরত্ব নেই। ফলে প্রোফাইল ছবিটিও তার সঠিক অবস্থান বাম পাশ থেকে অনেকটা ডানপাশে সরে এসেছে। যদিও দ্বিতীয় স্ক্রিনশটে নম্বরের সাথে ভিডিও কল আইকনের কিছুটা স্পেস বা ফাঁকা জায়গা দেখা গেছে তবে তাতে প্রকৃত হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনশটের মতো সমান্তরাল স্পেস নেই।
পাঁচ.
হোয়াটসঅ্যাপের ইন্টারফেসের নম্বর বার বা প্রোফাইল বার-এ দেখতে পাওয়া নম্বর প্যাটার্নের সাথে কথোপকথনের রিপ্লাইয়ে দেখতে পাওয়া প্যাটার্ন একইভাবে নেই। সাধারণত এই প্যাটার্নও একই থাকে। ফেসবুকের প্রচারিত পোস্টটির সপ্তম স্ক্রিনশট (বামে) ও প্রকৃত হোয়াটসঅ্যাপের (ডানে) ইন্টারফেসের মধ্যে পার্থক্য দেখুন--
প্রথমত আমরা পরীক্ষামূলকভাবে একটি সেইভড নয় এমন নম্বর থেকে পাওয়া মেসেজের রিপ্লাই করে দেখেছি সেখানে নম্বর বারে যে প্যাটার্নে নম্বর থাকে রিপ্লাইয়ের সময়েও প্রিভিউতে একই প্যাটার্নে নম্বর দেখা যায়। কিন্তু উপরের ছবির বাম পাশের স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে নম্বর বারে 42 এর পরে স্পেস দেখা গেলেও মেসেজের রিপ্লাইয়ের সময়ে প্রিভিউতে 42 এর পরে স্পেস নেই অর্থাৎ একই প্যাটার্নে নেই।
দ্বিতীয়ত আমরা পরীক্ষামূলকভাবে একটি নম্বরকে কোনো নামের পরিবর্তে আলোচ্য "+৪৪ 01671-425588" নম্বর লিখে সেইভ করেছি। সেই নম্বর থেকে একই মেসেজ পাঠিয়ে সেটির রিপ্লাইয়ে দেখেছি যে যেভাবে সেইভ করা সেই প্যাটার্নেই প্রিভিউ দেখা যাচ্ছে। এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের এন্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছে।
এই পাঁচটি প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায়, স্ক্রিনশটগুলো সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে।
UI-কনসিস্টেন্সি:
UI-কনসিস্টেন্সি বলতে একটি অ্যাপ্লিকেশনের (এখানে WhatsApp) ইন্টারফেসের প্রতিটি অংশে একই ধরণের ভিজ্যুয়াল ও ইন্টারঅ্যাকশন রুল বজায় রাখা। ভাইরাল স্ক্রিনশটগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এগুলোর লেখার মধ্যে UI-কনসিস্টেন্সিও ঠিক নেই। সাধারণত, হোয়াটসঅ্যাপের যেকোন প্রোফাইল সবসময় একইভাবে দেখাবে; যেমন: ফোন নম্বর, প্রোফাইল পিকচার, একই ফোন থেকে একই প্রোফাইলের চ্যাটে ফন্ট, একাউন্টের মোবাইল নম্বরের স্টাইল একই রকম থাকার কথা। এবং স্ক্রিনশট নিলে তা একই রকম দেখাবে সব সময়। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন রকম স্পেস আর লেখার স্টাইল। এই থেকে বুঝা যায় যে এই স্ক্রিনশটগুলা সম্পূর্ণ বানানো এবং ভুয়া।
পাশাপাশি, প্রতিটি স্ক্রিনশটেই উপরে কন্টাক্ট নম্বর দেখানো হয়েছে, সাথে নাম্বারের আগে “৪৬” লেখা। কিন্তু "৪৬" সাধারণত WhatsApp নামের জায়গায় দেখায় না। আবার সব স্ক্রিনে একই ফরম্যাটে "৪৬" দেখানো হয়েছে, যা অস্বাভাবিক এবং কনসিস্টেন্সি নষ্ট করছে।
প্রথম ৫টি ছবির কোলাজ দেখুন--
আরো ৪টি ছবির কোলাজ দেখুন--
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাইবার সিকিউরিটি স্পেশালিস্ট ও সিকিউপেন্ট-এর ফাউন্ডার সিইও এন্ড সিটিও সাদমান তানজিম বুম বাংলাদেশকে বলেন, স্ক্রিনশটগুলোর টাইম, অ্যালাইনমেন্ট, হোয়াটসঅ্যাপের ইন্টারফেসের Top Bar এর ফোন নম্বরের অসঙ্গতি প্রমাণ করে, এগুলো এডিট করে তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া, কি-ওয়ার্ড সার্চ করে “ছবিসহ স্ক্রিনশট ফাঁস নিয়ে মুখ খুললেন বান্নাহ” শিরোনামে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘ইত্তেফাকে’র অনলাইনে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে বান্নাহ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “ফেক আইডি দিয়ে আমার নামে এসব ছড়ানো হচ্ছে। আগেও নভেম্বর ডিসেম্বরের দিক একটা ইন্ডিয়ান মেয়ের ছবি যেটা বাংলাদেশি মেয়ের বানিয়ে আমাকে নানানভাবে এক্সপোজ করার চেষ্টা করেছে।” স্ক্রিনশট দেখুন--
অর্থাৎ আলোচ্য পোস্টে প্রচারিত হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনশটগুলো এডিটেড।
সুতরাং সম্পাদিত স্ক্রিনশট দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহ এক তরুণীকে যৌন হয়রানি করেছে দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে ফেসবুকে, যা বিভ্রান্তিকর।