তারেক রহমানের সাথে খালেদা জিয়ার এই ছবিটি এআই দ্বারা সম্পাদিত
বুম বাংলাদেশ দেখেছে, এআই প্রযুক্তির সহায়তায় খালেদা জিয়ার একটি ছবি ব্যবহার করে আলোচ্য ছবিটি সম্পাদনা করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হাসপাতালের বিছানায় বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান; এমন একটি ছবি প্রচার করা হচ্ছে। একটি পোস্টে ছবিটিকে পুরাতন বলা হলেও সাম্প্রতিক কিছু পোস্টে ছবিটির সময় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এরকম কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
গত ৩ ডিসেম্বর ‘Dr. Saklayen Russel’ নামক একটি ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে ছবিটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, ছবিটি পুরাতন, লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তোলা হয়েছিল। পোস্টটির স্ক্রিনশটের কোলাজ দেখুন--
ফ্যাক্ট চেক:
বুম বাংলাদেশ যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি বিভ্রান্তিকর। খালেদা জিয়ার হাসপাতালের বিছানায় শোয়া অবস্থার একটি ছবির সাথে তারেক রহমানের একটি ছবি এআই প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধ্যমে আলোচ্য ছবিটি তৈরি করা হয়েছে।
রিভার্স ইমেজ সার্চ করে গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যমে হুবহু ছবিটির বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে খালেদা জিয়ার হাসপাতালের বিছানায় শোয়া অবস্থার ছবিটির অনুরূপ ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ২৮শে মে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ -এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ছবিটির (বামে) সাথে গণমাধ্যমে পাওয়া ছবিটির (ডানে) তুলনামূলক চিত্র দেখুন --
সাম্প্রতিক সময়ে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুইটি আলাদা ছবিকে একই দৃশ্যে জুড়ে দেওয়ার উদাহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনামূল্যে, অনেকটাই নিখুঁত এবং সহজলভ্য হওয়ায় এই ধরণের সম্পাদনার ক্ষেত্রে গুগলের জেনারেটিভ টুল 'জেমিনি' ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। জেমিনির ২.৫ ফ্ল্যাশ বা তার চেয়ে উন্নত মডেলে (ছবির ক্ষেত্রে ন্যানো ব্যানানা বলা হয়) আগের চেয়েও বেশি বাস্তবের ন্যায় যে কোনো ধরণের ছবি তৈরি করতে সক্ষম। Nano Banana হলো গুগল-এর Gemini 2.5 Flash Image মডেলটির কোডনেম বা অভ্যন্তরীণ ডাকনাম। এই মডেলটি মূলত একটি উন্নত এআই ইমেজ এডিটিং মডেল যা টেক্সট কমান্ড বা বর্ণনা ব্যবহার করে ছবি তৈরি এবং সম্পাদনা করতে পারে। সর্বশেষ হালনাগাদে জেমিনির মডেলগুলোকে আরো উন্নত করা হয়েছে।
জেমিনি টুল দিয়ে তৈরি কিনা নিশ্চিত হতে গুগলেরই SynthID নামক ডিটেকশন টুলে ছবিটিকে যাচাই করা হয়েছে। কেননা গুগলের জেনারেটিভ টুলগুলো তাদের ইমেজ কন্টেন্টে সাধারণ ওয়াটারমার্কিংয়ের পাশাপাশি 'SynthID' নামক এক ধরণের ওয়াটারমার্কিং ব্যবহার করে যা খালি চোখে শনাক্ত করা যায়না। তবে গুগলের SynthID ডিটেকশন টুল সেটি শনাক্ত করতে পারে।
এই শনাক্তকরণ টুলের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটি যাচাই করলে ছবিটির ক্ষেত্রে 'গুগলের এআই ইমেজ জেনারেটিভ মডেল ব্যবহার করা হয়েছে' বলে ফলাফল দিয়েছে এবং ছবিতে SynthID শনাক্ত করেছে। দেখুন--
যদিও ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটি এবং গণমাধ্যমে প্রাপ্ত দুইটি ছবির মধ্যে বেশিরভাগ মিল পাওয়া গেলেও তারেক রহমানের ছবি ও পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে খুবই সামান্য কিছু অংশের অমিল দেখা যায়। খালেদা জিয়ার মূল ছবিকে এআই দ্বারা সম্পাদনা করে নতুন ছবি তৈরি করার ক্ষেত্রে এআই ফলে কিছু অমিল দৃশ্য ছবিটিতে যুক্ত হওয়া সম্ভব। যেমন দুইটি আলাদা আলাদা স্যালাইনের স্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে যা সঙ্গত নয়। এছাড়াও একটি স্যালাইনের স্ট্যান্ড বেড থেকে বেশ দূরে দেখা যাচ্ছে।
এমনকি প্রচারিত ছবিটিতে তারেক রহমানের পেছনের দিকের একটি দৃশ্য প্রতিস্থাপিত অবস্থায় দেখা যায়। ঢাকা ট্রিবিউনের ২০২১ সালের ১৬ই নভেম্বরের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবির সাথে (ডানে) ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটির (বামে) তুলনা করলে দেখা যায় যে মূল ছবির একটি দৃশ্যের অনেকখানি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। দেখুন--
ছবিতে দেখা যাচ্ছে কালো রঙয়ের অংশের অনেকখানিই পাশের দেয়ালের দৃশ্য দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বাকি অমিলের দৃশ্যটুকু এআই এর কারণে হয়েছে নাকি একই দৃশ্যের দীর্ঘ ফ্রেমের ছবির কারণে কম দীর্ঘ ছবির সাথে অমিল মনে হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও এই দৃশ্যের দীর্ঘ ফ্রেমের ছবিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানে উন্মুক্ত উৎসে কোথাও পাওয়া যায়নি।
ঢাকা ট্রিবিউনের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ছবিটি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে তোলা ঐ বছরের মে মাসে। সার্চ করে ২০২১ সালের মে মাসের শুরুতে এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
বিবিসি বাংলার সেসময়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'গত ১১ই এপ্রিল খালেদা জিয়ার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। সে সময় সিটি স্ক্যান রিপোর্টে তাঁর ফুসফুসে পাঁচ শতাংশ সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর গত ২৫শে এপ্রিল খালেদা জিয়ার দ্বিতীয়বারের মতো কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হলে সেখানেও তার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল। পরে জটিলতা দেখা দেয়ায় গত ২৭শে এপ্রিল থেকে এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মিসেস জিয়া।'
এদিকে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে পরিবারের সদস্যদেরকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আশ্রয় নেন তারেক রহমান। এরপর থেকে তিনি বিদেশেই রয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেননি। তাই ২০২১ সালে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সাথে তারেক রহমানের সাক্ষাতের বিষয়টি সম্ভব নয়। যদিও সম্প্রতি তার দেশে ফেরার বিষয়টি নিয়ে দেশব্যপী আলোচনা চলছে।
অর্থাৎ খালেদা জিয়ার একটি ছবিতে গুগলের এআই মডেল ব্যবহার করে তারেক রহমানের ছবিটি সম্পাদনার মাধ্যমে পরবর্তীতে যুক্ত করা হয়েছে। মূল ছবিটিও লন্ডনের নয় বরং এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসাধীন অবস্থার।
উল্লেখ্য বিবিসি বাংলার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শারীরিক জটিলতা নিয়ে গত ২৩ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তবে পরে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে 'সংকটাপন্ন' অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার খবর আসে গণমাধ্যমে। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে বলেই জানিয়েছে দলটির মুখপাত্র।
সুতরাং সামাজিক মাধ্যমে এআই প্রযুক্তিতে সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি ছবি বাস্তবে ধারণ করা ছবি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।




